প্রশ্নঃ ব্রত কাকে বলে ? ব্রত কয় প্রকার ? প্রত্যেক প্রকার ব্রতর পরিচয় দাও ও তাদের মধ্যে পার্থক্য কী তা আলোচনা করো ।
অথবা
প্রশ্নঃ ব্রত কাকে বলে ? ব্রত কয় প্রকার ? ব্রতের বৈশিষ্টগুলি লেখো ।
Ans:
।। ব্ৰত কী ।।
বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ এই বাংলাদেশ। এমন মাস খুবই কমই আছে এই বাংলায়, যার কোন না কোনমাসে কোন ব্রতের অনুষ্ঠান হয় না। মূলত নারীর কামনা-বাসনা পুরণের জন্য কৃত্য সম্পাদনই ব্রত। অর্থাৎ কোন কিছুর কামনা প্রার্থনায় নারীসমাজ আন্তরিকভাবে যে সকল ক্রিয়াচার পালন করে তা-ই হল ব্রত। অবনীন্দ্রনাথের মতে, 'কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলি ব্রত। ‘বৃ' ধাতু থেকে ব্রত শব্দের উৎপত্তি। ব্রত কথাটির সাধারণ অর্থ নিয়ম বা সংযম। যে ব্রত পালন করে সে ব্রতী। সাধারণত কোনকিছু কামনা করে দেবতার কাছে বিশেষ প্রার্থনা জানিয়ে (ক্ষেত্র বিশেষ আলপনা দিয়ে) কোন বিশেষ আচার পালন বা অনুষ্ঠান করা কিংবা পার্থিব কল্যাণ কামনায় দশে মিলে যে সামাজিক নিয়ম বা অনুষ্ঠান পালন করা হয় তাকে ব্রত বলা হয়। লেখক অবনীন্দ্রনাথ ব্রত বলতে কি বোঝায়, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণে না গিয়ে সরাসরি ব্রতের শ্রেণী-বিভাগ দিয়ে গ্রন্থের সূচনা করেছেন।
➤➤ ব্রতের শ্রেণীবিভাগ ও তার পরিচয়।।
আমাদের দেশে চলিত ব্রতের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে 'বাংলার ব্রত' গ্রন্থের শুরু। লেখক প্রথমে প্রচলিত ব্রতের প্রধান দুটি ভাগের কথা উল্লেখ করেছেন—–শাস্ত্রীয় ব্রত এবং যোষিদপ্রচলিত বা মেয়েলি ব্রত। আর মেয়েলি ব্রত বলে প্রচলিত ব্রতকে তিনি আবার দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—কুমারী ব্রত এবং নারীব্রত। মূলত পাঁচ-ছয় থেকে আট-নয় বছরের অবিবাহিতা কুমারী মেয়েরা যে ব্রতগুলো পালন করে, তাকে তিনি কুমারী ব্রত বলে উল্লেখ করেছেন, আর তদূর্ধ্বে বড়ো বয়সের মেয়েরা বিয়ের পর যে ব্রতগুলো পালন করে, তাদের তিনি নারী ব্রত বলে উল্লেখ করেছেন। লেখকের ব্রতের শ্রেণীবিন্যাসকরণ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাংলার ব্রতের কথা বলতে গিয়ে তিনি মেয়েলিব্রতের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করবেন বা সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাবেন। কিন্তু লোকায়ত এই ব্রত-পরিচয়ের পাশাপাশি লেখক সমাজে প্রচলিত শাস্ত্রীয় ব্রতকে একেবারে এড়িয়ে যাবেন না। লেখক এড়িয়ে যান নি। বরঞ্চ দুই শ্রেণীর ব্রতের মধ্যে তুলনাত্মক আলোচনার মধ্যে দিয়ে দুই শ্রেণীর ব্রতেরই সম্যক পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
লেখক অবনীন্দ্রনাথ ব্রতের শ্রেণীবিভাগ তাঁর নিজের মতো করেই করেছেন।
ব্রতের প্রকার ভেদ ঃ
ক) শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক
খ) অশাস্ত্রীয় বা লৌকিক
১) নারী ব্রত
১.১) কুমারীব্রত
১.২) সধবাব্রত
১.৩) বিধবা ব্রত
১.৪) যৌথব্রত (কুমারী-সধবা-বিধবা)
২) পুরুষব্রত
৩) নারী-পুরুষ যৌথ ব্রত
—ব্রতের শ্রেণীবিভাগের এই বিস্তারের দিকে না গিয়ে লেখক মূলত শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় বা মেয়েলি কিংবা নারী ব্রতেরও কুমারী ব্রতের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়ে ব্রত উৎপত্তির কারণ, তার বিষয়বস্তু, তার মধ্যেকার সমাজ-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, তার আলপনা নিয়েই আলোচনা করেছেন। এবং একটি বিষয় লক্ষণীয় লেখক তাঁর গ্রন্থে আলোচনাকে আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট কোন অধ্যায় ভাগ করে করেননি। একটানা আলোচনা করেছেন। মনে হয় যেন এক নিঃশ্বাসে সমস্ত কথাগুলো তিনি বলে গেছেন। অতিরিক্ত অধ্যায় বিন্যাসে লেখার বিষয়কে পাঠকের মনের উপর বোঝা করে দিতে চাননি তিনি। মুখ্য বিষয়টাকে একটানা বলে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
শুরুতেই লেখক শাস্ত্রীয় ব্রত, নারী ব্রত ও কুমারী ব্রতের গঠন প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন উদাহরণসহ।
➤ এ পর্বে প্রথমেই এসেছে শাস্ত্রীয় ব্রত। শাস্ত্রীয় বা পৌরাণিক ব্রতের উপাদান বা গঠন সামান্যকাণ্ড ও ব্রতকথা এই দুয়ের উপর নির্ভরশীল। এ জাতীয় ব্রত মূলত একটা গতানুগতিক পদ্ধতি নির্ভর। এবং সকল শাস্ত্রীয় ব্রতে সেই পদ্ধতি পালনীয় বিশেষ করে তার সামান্যকাণ্ড অংশটুকু। সামান্যকাণ্ড হলো কতকগুলো পালনীয় আচার-যেমন –আচমন, স্বস্তিবাচন, কর্মারও, সংকল্প, ঘটস্থাপন, পঞ্চগোব্যশোধন, শাক্তিমন্ত্র, সামান্যর্ঘ্য, আসনশুদ্ধি, ভূতশুদ্ধি মাতৃকান্যাসাদি এবং বিশেষার্য্যস্থাপন। এরপর চুদি উৎসর্গ ও ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দান করে ব্রতকথা শ্রবণ। এই হলো শাস্ত্রীয় ব্রতের ব্যাপার। কেবল নিয়মের বাহার।
➤ অন্যদিকে নারীব্রত কিছুটা শাস্ত্রীয় ব্রত ও কিছুটা মেয়েলি ব্রতের মেলবন্ধন। অর্থাৎ শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় ব্রতের যুগলমূর্তি হল নারী ব্রত। বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা ও সজীবতা অনেকখানি চলে গিয়ে ও লৌকিক ব্রতের সরলতা প্রায় নষ্ট হয়ে পুজারি ব্রাহ্মণ ও সামান্যকাণ্ডের জটিল আনুষ্ঠানিকতা এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
🔵➤ একমাত্র কুমারী ব্রত-ই শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতার বাঁধন এড়িয়ে অনেকখানি আপন অকৃত্রিমতায় অক্ষত রেখেছে নিজেকে। ব্রতের গঠন অনেকটা এই রকম— আহরণ, আচরণ, কামনা জ্ঞাপন, ব্রত কথা শ্রবণ। আহরণ হলো— ব্রতে যা যা লাগবে তা সংগ্রহ করা; আচরণ হলো— কামনার প্রতিচ্ছবি স্বরূপ আলপনা দেওয়া, পুকুরকাটা ইত্যাদি; কামনাজ্ঞাপন পর্যায়ে কামনার কথা জানিয়ে কামনার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিকৃতিতে ফুল ধরা এবং সব শেষে ব্রত কথা থাকলে তা শোনা, না হলে ফুল ধরে শেষ কামনা জানিয়ে ব্রত সাঙ্গ করা। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা তন্ত্রমন্ত্রের কোন ভূমিকাই এখানে নেই।
তিন প্রকার ব্রতের পারস্পরিক গঠন আলোচনায় একটা বিষয় লেখকের মতে স্পষ্ট যে, এই শাস্ত্রীয় ব্রতগুলি না পুরাতন আচার-ব্যবহারের চর্চার বেলায় না লোকসাহিত্য বা লৌকিক ধর্মাচরণের অনুসন্ধানের সময় কাজে লাগে। লোকের সঙ্গে এই ব্রতগুলির খুব কম যোগ, লোকের চেষ্টা লোকের চিন্তার ছাপ এই শাস্ত্রীয় ব্রতগুলি মোটেই নয়।' যজুঃ এবং সামবেদের অনেক মন্ত্র ও অনুষ্ঠান এই ব্রতগুলোতে থাকলেও বৈদিকক্রিয়ার সঙ্গে এগুলোর কলের পুতুলে আর জীবন্ত মানুষের মতো প্রভেদ। সে তুলনায় ‘খাঁটি মেয়েলি ব্রতগুলিতে, তার ছড়ায় এবং আলপনায় একটা জাতির মনের, তাদের চিত্তার, তাদের চেষ্টার ছাপ স্পষ্ট। এবং এ সূত্রে মেয়েলি ব্রতের সঙ্গে বেদের সুক্তের একটা মিল লক্ষিত। কারণ, বেদের সূক্তগুলোতে সমগ্র আর্যজাতির চিত্তা, তাঁর উদ্যম-সৎসাহ ফুটে উঠতে দেখা যায়। এভাবে তুলনামুলক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখক দেখানোর চেষ্টা করেছেন 'এ দুয়েরই মধ্যে লোকের আশা-আশঙ্কা, চেষ্টা ও কামনা আপনাকে ব্যক্ত করেছে এবং দুয়ের মধ্যে এই জন্যে বেশ একটা মিল দেখা যাচ্ছে। নদী, সূর্য এমনি অনেক বৈদিক দেবতা, মেয়েলি ব্রতেও দেখি এঁদেরই উদ্দেশ্যে ছড়া বলা হচ্ছে।'
বাংলা ব্রতের বৈশিষ্ট্য
ব্রত কথাটির সাধারণ অর্থ নিয়ম বা সংযম। সাধারণত কোন কিছু কামনা করে দেবতার কাছে বিশেষ প্রার্থনা জানিয়ে কোন বিশেষ আচার পালন বা অনুষ্ঠান করা কিংবা পার্থিব কল্যাণ কামনায় দশে মিলে যে সামাজিক নিয়ম বা অনুষ্ঠান পালন করা হয় তাকেই ব্রত বলা হয়।
🔵 ব্রত একক ক্রিয়া অনুষ্ঠান নয়, এ
🔵 কের কামনা দশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে ব্রতের অনুষ্ঠান।
🔵 ব্রতের মধ্যে সর্বদা একটা কামনা প্রকাশিত হয়। কামনা বাসনার বাস্তব রূপায়ণের জন্যই ব্রতের আয়োজন।
🔵 বাংলা ব্রত বা বাংলার মেয়েলি ব্রতের কতকগুলো পর্যায় থাকে, আহরণ, আচরণ, কামনাজ্ঞাপন, ব্রতকথা শ্রবণ ইত্যাদি।
আহরণ অর্থে, ব্রতে যা যা লাগবে তা সংগ্রহ করা। অর্থাৎ উপকরণ সংগ্রহ। ব্রতের উপকরণকে উপাচারও বলে। সাধারণত ব্রতের উপকরণ বা উপাচারের মধ্যে পড়ে— ঘট, আম্রপল্লব, ফুল, দুর্বা, ধান, প্রদীপ, তুলসী, বেলপাতা, সিদ্ধি, হরিতকি, তিল, দধি, মধু, চিনি, ঘৃত, সশীষ ডাব, পঞ্চশস্য, পান, সুপারি, চাল, চালের গুঁড়ো, ধানের শীষ বা ছড়া, কুলো, সিঁদুর, পিটুলি, পাকাকলা, ধুতি বা শাড়ী, গামছা, ধুপ-ধুনা, ঘটি, সরা, থালা, মধুপর্কের বাটি, তামার টাট, গঙ্গাজল, আসন, পিঁড়ি, পুষ্পমালা, চাঁদমালা, ফলফুলের নৈবেদ্য, যজ্ঞকাঠি, পাঠকাঠি, চন্দনকাঠ, বালি, দক্ষিণা ইত্যাদি। এর মধ্যে ধানের শীষ, পিটুলি, সরা, পিঁড়ি, ঘট, প্রদীপ, আম্রপল্লব ইত্যাদি হল ব্রতের শিল্পকলার বা মঙ্গল কামনার উপকরণ। বাংলার ব্রতের উপকরণগুলি এদেশীয় আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সংস্কৃতির এক চলমান চিত্র উদ্ঘাটিত করে। ব্রতের শুরুতে এইসব উপকরণ উপচার সংগ্রহকে আহরণ বলে।
🔵 আহরণের পরের পর্ব আচরণ, আচরণ হল ব্রতের পালিত নিয়মবিধি। যে ব্রত পালন করে সেই হল ব্রতী। ব্রতী বা ব্রতিনীকে আহরণ কর্মের পাশাপাশি ব্রতের আচরণের প্রস্তুতি নিতে হয়। ব্রতী বা ব্রতিনী স্নান করে শুচিবস্ত্রে উপবাসী থেকে ব্রত পালন করে। ব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে নারীদের ত্যাগ, নিষ্ঠা, সংযম, সুপ্ত-কামনা-বাসনা বা কল্পনা এবং একাগ্রতার প্রকাশ ঘটে। মুল কথা হল এই যে, প্রাতঃস্নান, উপবাসী থাকা, ব্রতাচার পালন, আলপনা দেওয়া, পুকুর কাটা, ছড়া বলা, ব্রত কথা বলা বা শোনা ইত্যাদি হল ব্রতের আচরণীয় নিয়ম। আচরণ পর্বের মধ্যে দিয়ে ব্রতীর নিয়ম-নিষ্ঠা বা সংযমের প্রকাশ ঘটে।
🔵আচরণপর্বের অন্যতম প্রধান আচার আলপনা দেওয়া। আলপনায় ব্রতীর কামনার প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে। আলপনার অলংকরণের এক একটা চিত্রে যেমন আর্থ-সামাজিক দিকটি স্পষ্ট হয়, তেমনি এক একটা চিত্রে ব্রতীর কামনার নানা রূপ ধরা পড়ে।
🔵 শুধু আলপনা নয়, আচরণ পর্বে পুকুর কাটা ও ফুল ধরা প্রভৃতি ক্রিয়া অনুষ্ঠানও সংঘটিত হয়। কামনাজ্ঞাপন ব্রতের মূল অংশ বলা যায়। আলপনাগুলো কামনার প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবিগুলোতে এক একটা ফুল ধরে এক একরকম কামনা জানানো হয়। কামনাগুলোর বাঙ্ময় প্রকাশ ঘটে ছড়ার মধ্যে। কাম্য আকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি স্বরূপ আঁকা ছবিগুলোতে এক এক করে ফুল দিয়ে সুপ্ত কামনার বাহা প্রকাশ ঘটানো হয় ছড়ার মধ্যে দিয়ে। এক একটা আলপনাতে ফুল দেওয়ার পর আলপনার অন্যছবিতে ফুল দিয়ে কামনাজ্ঞাপক ছড়া উচ্চারণ করা হয়। ফুল দেওয়া ব্যাপারটি অনেকটা বাজারের ফর্দে টিক দেওয়ার মতো। অর্থাৎ কোন আলপনাতে কামনা জানানো হয়ে গেছে তার চিহ্ন থেকে যায় ওই ফুলের মধ্যে।
=====================
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
No comments