লোককথা
গল্প শোনার আগ্রহ মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। প্রাচীন মানুষ সারাদিন কাজ-কর্মের শেষে যখন একজায়গায় জড়ো হত রাতে, তখন তারা বয়স্ক কোন ব্যক্তির কাছে গল্প শুনতো নানান অভিজ্ঞতার, কাজ কর্মের ও কল্পনার। গল্প শোনার এই প্রবৃত্তিটি ক্রমশ মার্জিত হয়ে নতুন নতুন বিষয়-বস্তুর সন্ধান ও নতুনতর উপায়ে তাদের পরিবেশন কৌশল আয়ত্ত করে আজকের শিষ্ট সাহিত্যে উপন্যাস ও ছোটগল্পের আকারে প্রকাশ পেয়েছে। গল্প বলার এই শিল্পিত, আদর্শায়িত নাগরিকরূপের সমান্তরালে লোক সমাজে এর একটি সাধারণ মান থেকে গেছে, এই সাধারণ মানের উপর নির্ভর করে পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের লোকসমাজে লৌকিক কথাসাহিত্যের একটি ধারা তৈরি হয়ে গেছে। গদ্য ও পদ্য উভয় মাধ্যমে লৌকিক কাহিনী বর্ণিত হয়ে থাকে। পদ্যের ভিতর দিয়ে যা প্রকাশ করা হয়, তা গীতিকা নামে পরিচিত; গদ্যের ভিতর দিয়ে যে কাহিনী প্রকাশ করা হয় তা লোক কথা, ইংরেজিতে তাকে সাধারণভাবে Folk Tale বলা হয়।
রাত্রের কাজে অবকাশ তৈরি করে দিতে এই গল্পগুলো রাতে কিংবা সন্ধ্যাতেই পরিবেশিত হত। গল্পের বিষয়বস্তুর অবাস্তবতা, অলৌকিকতা ও অসম্ভবতাকে যথাসম্ভব বিশ্বাসযোগ্য করে তোলায় সহায়ক হত রাতের অন্ধকার পরিবেশ। দিনের আলোতে যা অসম্ভব বলে মনে হয় রাতের তারা-ভরা অন্ধকারের রহস্যময় পরিবেশে তা অনেকটা সহজবোধ্য হয়ে ওঠে শিশুর কাছে। এজন্যেও লোককথায় রাতের অদ্ধকারকে আশ্রয় করার প্রবণতা।
লোককথার নানারূপ
বাংলা লোককথার ভাণ্ডারটি বেশ সমৃদ্ধ। কেবলমাত্র লোককথা শব্দটি কিছুটা অপরিচিত, তার পরিবর্তে রূপকথা শব্দটি বিশেষ জনপ্রিয়। রূপকথা কিংবা লোককথা বলতে রাক্ষস-খোক্কস ও রাজা-রানি, রাজপুত্র রাজকন্যার গল্পই আমারে কাছে এক ঝলকে ধরা পড়ে। তবে, লোককথা বলতে কেবল রূপকথাকেই বোঝায় না। লোককথার একাধিক রূপ বর্তমান। যেমন— রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, বীরকথা, নীতিকথা, লোকপুরাণ ইত্যাদি।
রূপকথা: লোককথার সর্ববৃহৎ রূপ হল রূপকথা, এ জাতীয় গল্পে কল্পনার জালবোনা হয়। সাধারণত অতিরিক্ত কল্পনা প্রবণতা এ জাতীয় রচনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। রাক্ষস, দানব এবং পরীরাই রূপকথার কাহিনীতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশ অধিকার করে থাকে। সঙ্গে থাকে রাজা-রানি, রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, কোটালপুত্র ও রাজকন্যা প্রমুখেরা। এ জাতীয় লোককথার কাহিনীতে তেমন বৈচিত্র্য থাকে না। সেই বাঁধা ধরা এক গৎ – এক ছিল রাজা, তার সাত রানী, রাজার মনে ভারি দুঃখ, ইত্যাদি। এ জাতীয় রচনায় চরিত্রের কোন নামকরণ নেই এবং সমগ্র কাহিনীটিই নির্বিশেষ চরিত্রে পূর্ণ। এই নৈর্ব্যক্তিক ও সার্বজনীনভাব অবলম্বন করে রূপকথা রচিত বলে এজাতীয় রচনা সহজেই দেশ দেশান্তরে প্রচারিত হতে পারে। বলে Fairy Tale, বাংলায় বলে রূপকথা। লোককথার এই রোমান্সধর্মী, কল্পনাপ্রবণ শাখাটিকে ইংরাজিতে
সাধারণত, লোকসমাজের কল্পনাপ্রবণ মনটি ধরা পড়ে রূপকথার মধ্যে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রেমের পরই রূপকথায় ভাগ্যের স্থান। গ্রাম্য মানুষ স্বভাবতই তাদের জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার জন্য ভাগ্যকে দায়ী করে থাকে। রূপকথার গল্পে গ্রাম্য লোকসমাজের উক্ত মনোভাবই প্রকাশিত হয়। এ জাতীয় কাহিনীতে ধর্মের জয়, অধর্মের ক্ষয় বা পরাজয়, ন্যায়ের বিচার, উদ্যোগী কর্মীর জীবনে সাফল্য চিত্রিত হয়ে থাকে। সাধারণত এই আশাবাদী সুরটুকুই রূপকথাগুলোকে তার কল্পনা ও অলৌকিকত্বের মোহজাল ছিন্ন করে মানবজীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
রূপকথা জাতীয় লোককথা সাধারণত দীর্ঘ অবয়বের হয়, বিভিন্ন বিষয় ও বিচিত্র শাখাকাহিনী সহযোগে জটিল এ জাতীয় কাহিনী। এ জাতীয় গল্পের পরিবেশটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও স্বপ্নিল-সুনির্দিষ্ট কোনও স্থান ও সুস্পষ্ট কোনও চরিত্র অবলম্বন করে এ কাহিনী রচিত হয় না। অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর ঘটনা দ্বারা এ গল্প পরিপূর্ণ। এর নায়ক সাধারন্ত কোনও অপরিচিত দেশের রাজপুত্র, বহুদুরের কোন এক নতুন অপরিচিত দেশে প্রবেশ করে অসম্ভব কতগুলো বিপদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সবশেষে সে দেশের রাজকন্যাকে বিয়ে করে ও • সেখানকার সিংহাসনের উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে গল্পের পরিসমাপ্তি। সমাপ্তি সাধারণত সমাপ্তিবাচক ছড়ার মধ্যে দিয়ে। বাংলার উপকথা কিংবা ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি এই জাতীয় রচনার দৃষ্টান্ত।
উপকথা। 'রূপকথা' শব্দটি লোকসমাজে উচ্চারণজনিত ত্রুটির ফলে উপকথা'তে পরিণত হয়েছে এ ধারণা অনেকের। তবে, যতই উচ্চারণ বিকৃতি ঘটুক না কেন, উপকথা লোককথার একটি বিশেষ শাখা। লোককথার অন্যতম একটি বিশেষ চরিত্র পশু-পাখি। এই পশু-পাখিকেন্দ্রিক লোককথাকে ইংরাজিতে বলে Animal Tale | এ জাতীয় গল্পে নরনারী ও পশু-পাখি উভয়েই সমান অংশগ্রহণ করে থাকে। এখানে পশু-পাখি চরিত্রগুলো সব মানুষের মতো আচরণ করে। কিংবা মানবচরিত্রগুলো পশুপক্ষীর ছদ্মবেশে এ কাহিনীতে উপস্থাপিত হয়। এভাবে পশু-পাখি যখন মানুষের তো কথা বলে বা আচরণ করে তখন স্বাভাবিকভাবে হাস্যরসের উপস্থাপনা ঘটে। অথবা কোন পশুর নির্বুদ্ধিতার দ্বারা কৌতুকরসের সৃষ্টি হয়। এজাতীয় গল্পে ধূর্ত ও নির্বোধ - দুই শ্রেণীরই পশু পাখি থাকে চরিত্রগত এই বৈপরীত্য নির্দেশ করার ফলে এ জাতীয় রচনায় সহজ একটি নাটকীয় গুণ প্রকাশ পায়। এ জাতীয় কাহিনীর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দুর্বল এবং অসহায়ের প্রতি সমবেদনা। এ ধরনের লোককথাকে বাংলায় বলা হয় উপকথা। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই' এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নীতিকথাঃ অনেক সময় পশু-পাখিকেন্দ্রিক লোককথা বা উপকথা বা Animal Tale-এ একটি নীতি বা উপদেশ সংযুক্ত থাকে, ইংরাজিতে এজাতীয় লোককথাকে বলে fable, বাংলায় উপকথার এই শাখাকে নীতিকথা বলা হয়। এজাতীয় রচনায় লোকসমাজ সাধারণত একটি শিক্ষণীয় বিষয় পায়। ইংরাজিতে Esop's Fable, সংস্কৃত সাহিত্যের ‘পঞ্চতন্ত্র' ও 'হিতোপদেশ' এ জাতীয় রচনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ব্রতকথা : কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই ব্রত বলে। ব্রত পালনের উপলক্ষ্যে যে গল্প, তাই ব্রতকথা। সাধারণত নারী-সমাজ সংসারের সুখ-শাস্তি কামনায় সারাবছর ধরে এক একটা প্রার্থনায় এক একটি দেবীর কাছে তাদের মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনার কথা জনায়। নারী-হৃদয়ের ওই কামনা বাসনা, উক্ত দেবীর পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচারকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ব্রতকথা। ব্রতকথার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য মঙ্গল সাধন। এ জাতীয় রচনার ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্য অপরিসীম। যদিও এখানে কল্পনা ও অলৌকিকত্ব সর্বাংশে বিদ্যমান, তবু নারী মনের কামনা-বাসনা, আশা-আকাঙক্ষা, সুখ-দুঃখ প্রকাশের মধ্যে সমাজ সত্য কিংবা ঐতিহাসিক সত্য কোন না কোনভাবে প্রকাশিত হয়ে যায় এ জাতীয় লোককথা কেবল শ্রবণযোগ্য নয়, অনুষ্ঠান করে পালনেরও। দেবতার কাছে কামনা-বাসনা জানিয়ে, আলপনা এঁকে পূজার পর ব্রতকথা শোনার নিয়ম। ব্রতকথার সংকলন গ্রন্থ 'মেয়েদের ব্রতকথা'।
বীরকথা : একটি মাত্র কেন্দ্রীয় দুঃসাহসী ও অলৌকিক শক্তি-সম্পন্ন বীরচরিত অবলম্বন করে যে একাধিক কাহিনী রচিত হয়, তাকে ইংরাজিতে বলে Hero Tale, বাংলায় বলে বীরকথা। এ জাতীয় লোককথা রূপকথা ও লৌকিক উপন্যাসের মিশ্র উপাদানে রচিত, এতে পারিপার্শ্বিক ঘটনা অপেক্ষা নায়ক-চরিত্রই প্রাধান্য লাভ করে। বাংলায় এ জাতীয় লোককথার দৃষ্টান্ত তেমন নেই।
No comments