উত্তর :- ষোড়শ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপে যে অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও বিকাশের ধারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা ইতিহাসে মার্কেন্টাইল অর্থনীতি নামে পরিচিত। আধুনিক পুঁজিবাদের জনক এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ তার 'Wealth of Nation' গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বলা যায় মার্কেন্টাইল মতবাদ সমকালীন ইউরোপের পুঁজিপতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রতিপত্তি অর্জনের এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঐতিহাসিক মরিস ডব লেখেন, 'মার্কেন্টাইলবাদ ছিল বাণিজ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং একটি আদিম সঞ্চয়শীল অর্থনীতি।' মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের মতে, ‘মার্কেন্টাইলবাদ ছিল বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির একচেটিয়া অধিকারের মতাদর্শ।' মার্কেন্টাইলবাদ প্রবক্তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বিদেশি বাণিজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে রক্ষা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পাবে।
● মার্কেটাইলবাদের উদ্দেশ্য : প্রত্যক্ষভাবে জনকল্যাণময় রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি মার্কেন্টাইলবাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। ব্যক্তি বা জনসমষ্টির আর্থিক উন্নয়নের চেয়ে মার্কেন্টাইলবাদ আরও বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিল সেই সকল বাণিজ্যিক সংগঠন গুলির ওপর যারা শিল্প বাণিজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
ব্যাপক আর্থিক উন্নয়ন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, ঔপনিবেশিক বিস্তার, মুদ্রার ব্যবহার এবং জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান এই পাঁচটি ঘটনা মার্কেন্টাইল মতবাদকে সহায়তা করেছিল। কিভাবে এই আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল এবং এই উন্নয়নে বাণিজ্য, উপনিবেশ, মুদ্রার ভূমিকা কি ছিল মার্কেন্টাইলবাদ তা ব্যাখ্য দেওয়ার চেষ্টা করে।
মধ্যযুগে আর্থিক ক্ষমতা ছিল স্বাধীন নগর সমূহ, স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা, চার্চ এবং রাজতন্ত্রের মধ্যে কেন্দ্রীভূত। এই সংগঠনগুলি একান্ত ভাবে নিজস্ব অধিকার ও বিশেষ সুযোগ সুবিধা অর্জন ছিল এদের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্র উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক ক্ষমতা একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত, হতে শুরু করে। এভাবে জাতীয় রাষ্ট্র উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মার্কেন্টাইলবাদ গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। শুধু তাই নয়, বণ্টন ও ভোগ ছিল মধ্যযুগীয় অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু মার্কেন্টাইল অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদন ও রপ্তানি।
* মার্কেন্টাইল মতবাদের বৈশিষ্ট্য : মার্কেন্টাইল অর্থনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ইউরোপের সোনা, রূপার আমদানি বৃদ্ধি। এই অর্থনীতির উদ্ভব ও বিকাশের ফলে দক্ষিণ আমেরিকার নববিজিত দেশগুলি থেকে প্রচুর সোনা, রূপা ইউরোপের দেশে আমদানি হতে থাকে। ইউরোপে অন্যান্য দেশের তুলনায় স্পেন বিপুল আমদানির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল। ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে এই মূল্যবান ধাতু ছিল সম্পদ, পুঁজি এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রধান উৎস। মার্কেন্টাইল মতবাদ পুঁজিবাদের উত্থানে সহায়তা করেছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টি আর্থিক বিষয়ে নিবদ্ধ হয়েছিল। বলা যায় রাষ্ট্রীয় সমর্থন পুঁজিবাদকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল।
ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের সঙ্গে মার্কেন্টাইল মতবাদ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল। ইউরোপীয় সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে বাণিজ্য, নৌশক্তি এবং উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এভাবে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল মতবাদ প্রয়োগের সুযোগ উপস্থিত হয়েছিল। বিশেষত আটলান্টিক তীরবর্তী দেশগুলিতে (পর্তুগাল, হল্যান্ড প্রভৃতি) এই নীতির ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
● মার্কেন্টাইলবাদের প্রসার : সপ্তদশ শতক থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মার্কেন্টাইলবাদ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছিল। পর্তুগালে প্রথমে মশলা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে মার্কেন্টাইল মতবাদ প্রয়োগ করা হয়েছিল। পর্তুগালের বাণিজ্যিক শ্রীবৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল উত্তমাসা অন্তরীপ দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথ আবিষ্কার। ইউরোপীয় অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় পর্তুগাল অনেক আগে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়া পর্তুগাল দুঃসাহসিক নাবিকদের নতুন দেশ আবিষ্কার ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল। মার্কেন্টাইল মতবাদের সঙ্গে সম্মতি রেখে পর্তুগাল আমদানি পরিবর্তে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়েছিল। স্পেনের মতো বিশাল Billion Reserve গড়ে তুলেছিল। এই মার্কেন্টাইল অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে পর্তুগাল ব্রাজিলে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
• স্পেনের সম্প্রসারণ : সপ্তদশ শতকে স্পেনের সামাজিক অবস্থা বণিক সম্প্রদায় উত্থানের পক্ষে খুব একটা সহায়ক ছিল না। এ কারণে স্পেনে মার্কেন্টাইল মতাদর্শের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও দেন কিছুটা পর্তুগালের অনুকরণে এবং কিছুটা নিজস্ব রীতিতে এক প্রকার মার্কেন্টাইল প্রথা গড়ে তুলেছিল। পর্তুগালের সঙ্গে স্পেনের তিনটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যথা —–
(১) রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন একচেটিয়া ঔপনিবেশিক বাণিজ্য
(২) Casa De-Contreition নামক সংস্থার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং
(৩) নতুন বিশ্বে বাণিজ্যের জন্য স্পেনীয়দের লাইসেন্স প্রদান করা।
• হল্যান্ড : হল্যান্ডের বণিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগে মার্কেন্টাইল অর্থনৈতিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। হল্যান্ডে কৃষিকে অবহেলা করা হয়নি। তা সত্ত্বেও কৃষিজাত পণ হল্যান্ডের সব প্রয়োজন মেটাতে পারেনি। কিছু পরিমাণ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। হল্যান্ডের শিল্প যথেষ্ট উন্নত হলেও কাঁচামালের জন্য তাকে আমদানির উপর নির্ভর করতে হত। দুটি ক্ষেত্রে হল্যান্ডের অর্থনীতি মার্কেন্টাইল অর্থনীতি থেকে পৃথক ছিল।প্রথমত, হল্যান্ড আমদানির উপর খুব সামান্য হারে শুল্ক বসিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তারা সোনা রুপো মজুতের উপর গুরুত্ব দেয়নি।
● ইংল্যান্ড : ইংল্যান্ডের টিউডর শাসনকালে মার্কেন্টাইল অর্থনীতি কার্যকরী হয়েছিল। ইংল্যান্ড পুরোনো আইনকে নতুন ভাবে প্রণয়ন করে স্বদেশি শিল্প সংরক্ষণ, কাঁচামাল আমদানি, সোনা রুপো নিষিদ্ধকরণ, বাণিজ্য ও রাজকীয় নৌবহর সৃষ্টি প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সূচনা, ইস্ট ইন্ডিয়া নেভিগেশন আইন ছিল মার্কেন্টাইল সুপ্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম প্রয়াস।
• জার্মানি ও ফ্রান্স : এই পর্বে জার্মানি ও ফ্রান্সের মার্কেন্টাইলবাদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ফ্রান্সে কোলকর্ডের শাসনকালে মার্কেন্টাইলবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। একাধিক স্বাধীন ও আধা স্বাধীন ছোট বড় রাজ্যে বিভক্ত জার্মানিতে মার্কেন্টাইলবাদের আঞ্চলিক রূপ Cameralism নামে পরিচিত।
অষ্টাদশ শতকের মার্কেন্টাইল অর্থনৈতিক ধ্যান ধারণা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। দার্শনিক দেবী হিউ, স্যার জসিয়া চাইল্ড, অ্যাডামস স্মিথ প্রমুখ একে তীব্র সমালোচনা করেন। তাদের মতে শিল্প ও বাণিজ্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক বিকাশ, উন্নয়ন ও ব্যাপক উৎপাদনের পরিপন্থী ছিল। অ্যাডাম স্মিথ মার্কেন্টাইল অর্থনীতির সমালোচনা করে আবাদ অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি মনে করতেন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে আর্থিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে উন্নয়নের হার বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ স্মিথ চেয়েছিলেন সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত শিল্প ও বাণিজ্য | নীতি। এই বিরূপ সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে মার্কেন্টাইলবাদ পরিত্যক্ত হয়। এর পরিবর্তে প্রাধান্য পায় অবাধ বাণিজ্য অর্থনীতি
No comments