উত্তর :- ইউরোপের নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল ইতালিতে। কারণ তুর্কি আক্রমণে কনস্টান্টিনোপল পতন হওয়ায় সেখানকার পণ্ডিতগণ ইতালির নগরগুলিতে আশ্রয় নেন। এর ফলে ইতালির নগরগুলিতে তাদের উদ্যোগে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞানচর্চার শুরু হয়। ভেনিস, ফ্লোরেন্স, মিলান নগরে বৃহৎ গ্রন্থাগার নির্মিত হয়। এছাড়াও ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ইতালির নগরগুলি ক্রুসেডের সময় থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে।
*(১) ইতালির বিপ্লব : ইতালির ভেনিস, মিলান, ফ্লোরেন্স প্রভৃতি শহরের ধনী
বণিকরা নবজাগরণের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের চেষ্টায় ইতালির বিভিন্ন শহরে সাহিত্যিক, চিত্রকর শিল্পী, বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছিল। মানবতাবাদের বিকাশ প্রথম ঘটে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীতে। এই নগরের উদ্যোক্তা ছিলেন কাসিমো ও লরেঞ্জা-দ্য-মেডিসি। এই শহরকে দ্বিতীয় এথেন্স নামে পরিচিত করা হত। শিক্ষাদীক্ষা শিল্পের উন্নতির জন্য ইতালির দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য নগর ছিল মিলান। এই নগরে ইস্পাতের কর্ম এবং রেশম ও পশমের পোশাক তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল। মিলানের শাসক ডিসকন্টি পরিবার ও বণিকরা মিলিত ভাবে নগরকে শিল্প সৌন্দর্যে অপরূপ করে তুলেছিল। পোপ লিও রোম নগরীকে শিল্পকলা ও শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেন। এইভাবে ইতালির নগরগুলি প্রাচীন গ্রিকের নগরগুলির মতো বহুমুখী সৃজনশীল প্রতিভার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিল।
• (২) মুদ্রণ বিপ্লব : পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মানিতে ছাপাখানার আবিষ্কার
ছিল নবজাগরণের অন্যতম অবদান। যোহান গুটেনবার্গ নামে এক জার্মান সীসা গলিয়ে ছাপার অক্ষর তৈরি করে বই ছাপা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির মেনিজ শহরে তিনি প্রথম ছাপাখানা স্থাপন করেন। এই ছাপাখানা থেকে তিনি যে বইটি প্রথম প্রকাশ করেন তার নাম হল 'Indulgenge of Nicholas V | মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে বাইবেল আর চার্চের অধীনে থাকল না। ইউরোপের সাধারণ মানুষ তা পাঠ করার সুযোগ পেল এবং এতদিন ধরে যাজকরা যা বলে এসেছিল তা যে ভুল তা বুঝতে পারল।
(৩) নবজাগরণের প্রভাবে শিক্ষাব্যবস্থা : নবজাগরণ বা নতুন চিন্তাধারার প্রভাব শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনুভূত হয়েছিল। সেই সময় কনস্ট্যান্টিনোপলই ছিল গ্রিক ও রোমান শিক্ষা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। এই নগরটি যখন অটোম্যান তুর্কিদের অধীনে চলে যায় তখন সেখানকার সুপণ্ডিত খ্রিস্টধর্মী মানুষরা নতুন বসতি গড়ে তোলেন ইতালি, ফ্রান্স ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে। এইসব নতুন স্থানে তারা গড়ে তুললেন বহু শিক্ষাকেন্দ্র। এইসব শিক্ষাকেন্দ্র ছাত্রদের শিক্ষা দিত সাহিত্য, ভাষা, শিল্প, দর্শন, গণিত ও বিজ্ঞান। তার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রিক, রোমান শিক্ষা সংস্কৃতির নবজাগরণ। এই শিক্ষার ফলেই জন্ম নিয়েছিল মুক্ত উদারমনের মানুষ। এরা পারলৌকিক জীবন থেকে ইহলৌকিক জীবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ধর্মের চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়। মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান—এই ধারণার বশবর্তী হয়েই জন্ম হয় মানবতাবাদের।
(৪) রাজতন্ত্রের মধ্যে নবচেতনা : পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইতালির পণ্ডিত এগ্রিকালা সর্বপ্রথম জার্মানিতে মুক্ত মনের শিক্ষার প্রসার করেন। ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস ইতালির পণ্ডিতদের নিজ দেশে নিয়ে নতুন শিক্ষাব্যবস্থার শুরু করেন। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ এবং ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ দেশে নতুন শিক্ষা প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
• মূল্যায়ন : এইভাবে নবজাগরণের প্রভাবে ইউরোপের প্রায় সকল সাধারণ মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। এর প্রভাব থেকেই জন্ম নেয় মানবতাবাদ কেন্দ্রিক সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন।
=====================
আরো দেখো 👉
➤ -নবজাগরণ কাকে বলে। সর্বপ্রথম ইতালিতে কেন নবজাগরণের সূচনা হয়। উত্তর দেখো ➤ রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলতে কী বোঝ। শিল্পে নবজাগরণের প্রভাব আলোচনা করো। উত্তর দেখো >>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
প্রশ্ন- নতুন বিশ্বে স্পেনের উপনিবেশ বিস্তার সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, ষোড়শ শতকে স্পেনের উপনিবেশ সম্পর্কে যা জানো লেখো।
উত্তর :-
ভূমিকা : নতুন বিশ্ব অর্থাৎ আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে স্পেনের উপনিবেশ আধিপত্য সর্বাধিক বিস্তৃত হয়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ফ্লোরিডা, মেক্সিকো, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত অঞ্চলে স্পেনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই উপনিবেশ বিস্তারের মধ্যে দিয়ে স্পেন ব্যবসা বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধি করেছিল। স্পেনের উপনিবেশ বিস্তার নিম্নে আলোচনা করা হল—
• উদ্দেশ্য : ইউরোপীয়রা দক্ষিণ আমেরিকায় সোনা ও রূপার বিশাল ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছিলেন। দক্ষিণ আমেরিকায় মূল্যবান ধাতুর ভাণ্ডার নিজেদের করায়ত্ত করা আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশ স্থাপনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্পেনীয়দের সামাজিক মর্যাদার উন্নতিবিধান, নিজেদের ধর্মীয় ভাবনার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি কারণে স্পেন নতুন বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনে অত্যন্ত আগ্রহী ছিল। এসব উদ্দেশ্যে স্পেন থেকে প্রচুর মানুষ নতুন বিশ্বে তাদের উপনিবেশগুলিতে এসে বসবাস শুরু করে। সর্বপ্রথম হিস্পানিওলা দ্বীপে এবং পরে কিউবা এবং পুয়ের্টোরিকোয় সোনা পাওয়া যায়।
• ক্রীতদাস আমদানি: প্রথমদিকে স্পেনীয়রা দক্ষিণ আমেরিকার পাহাড় থেকে সোনা নিষ্কাশণের উদ্দেশ্যে প্রচুর সংখ্যক স্থানীয় আদিবাসীদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করেছিল। কলম্বাসের আগমনের পূর্বে হিস্পানিওলায় প্রায় ১০ লক্ষ স্থানীয় আদিবাসী ছিল। কিন্তু রোগব্যাধি, খাদ্যাভাব ও স্পেনীয়দের নিষ্ঠুর শোষণের ফলে তাদের সংখ্যা খুবই হ্রাস পায়। ফলে আফ্রিকা থেকে প্রচুর সংখ্যক দাসকে শ্রমিক হিসাবে আমদানি করে এখানকার চা শ্রমিকের চাহিদা মেটানো হয়েছিল।
• প্রশাসন : স্থানীয়রা নতুন বিশ্বে তাদের উপনিবেশগুলিকে দূর থেকে শাসন করার চেষ্টা করেছিল। এই বিশাল উপনিবেশ স্পেনীয় রাজবংশের সঙ্গে রাজপ্রতিনিধি দ্বারা যুক্ত ছিল। তাই স্পেনের উপনিবেশকে পুরানো স্পেনের নির্ভরশীল রাজ্য না বলে ভগিনী রাজ্য বলা হয়। স্পেনীয় উপনিবেশ শাসনের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল Casa de contractaction এবং councile of indies। প্রথমটি সব রকমের বাণিজ্য দেখাশোনা এবং লাইসেন্স প্রদান, জাহাজগুলির তত্ত্বাবধান প্রভৃতি কাজে নিযুক্ত ছিল। দ্বিতীয়টি ছিল উপনিবেশ বিষয়ে বিশেষ পরামর্শদাতা ও প্রশাসকমণ্ডলী। স্পেনীয় সরকার কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে খুব বেশি ক্ষমতাশালী না হয়ে ওঠে সেজন্য checks and balance পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল। গভর্নরের কার্যকাল ছিল পাঁচ বছর থেকে দশ বছর।
• স্পেনীয়দের বসতি : সোনা ও রূপার খনি অঞ্চলকে ভিত্তি করে আমেরিকায় স্পেনের বসতি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অঞ্চল ছিল পটেসি। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে এখানকার জনসংখ্যা ছিল ১ লক্ষেরও বেশি। এছাড়াও নতুন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও স্পেনীয়রা বসতি গড়ে তুলেছিল।
● স্পেনীয় উপনিবেশিক অর্থনীতি : মূল্যবান ধাতু নিষ্কাশনের কাজকে কেন্দ্র করে আমেরিকা মহাদেশে স্পেনের ঔপনিবেশিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। স্পেনীয়রা আফ্রিকা থেকে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক এনে সোনা সংগ্রহ, কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ও উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োগ করত। সোনা সংগ্রহ ছাড়াও দাস শ্রমিকের অধিকাংশ আখ উৎপাদন কাজে নিযুক্ত হত। এখানকার সোনা এবং রূপা ছাড়াও তামা, চিনি, চামড়া প্রভৃতি ইউরোপে রপ্তানি করা হত। স্পেন রাজার অনুমতি ছাড়া আমেরিকায় অন্যান্য দেশের বাণিজ্য করার অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
•নতুন স্পেন : স্পেনীয়রা আমেরিকার বিভিন্ন অংশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সেখানে নতুন স্পেন গড়ে তোলে। ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চিলি পর্যন্ত অঞ্চলে স্পেনের ঔপনিবেশিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। স্পেনের অনুকরণে স্পেন আমেরিকায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে। আইনজ্ঞ ও যাজকদের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। স্পেনীয় শাসক, সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠী এবং স্থানীয় শ্রমিক-কৃষকদের নিয়ে এখানে মিশ্র সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। স্পেনের খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ আমেরিকায় তাদের কার্যাবলীর প্রসার ঘটান
• নতুন বিশ্বে স্পেনীয় উপনিবেশের অবসান : একাধিক কারণে আমেরিকায় স্পেনের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পতন হয়েছিল। স্পেনীয় উপনিবেশ পতনের একটি অন্যতম কারণ হল স্পেনের গৃহযুদ্ধ। সিংহাসনের উত্তরাধিকার যুদ্ধে স্পেন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে স্পেন দখল করে নিয়েছিল। ভ্রাতা জোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসিয়ে দিলে স্পেনের সঙ্গে আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত উপনিবেশগুলির সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার চিলি আর্জেন্টনা মেক্সিকো প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলি স্পেনের অধীনতা থেকে মুক্তি পায়।
No comments